সোমবার, ২৫ নভেম্বর ২০২৪, ১০:৩৯ অপরাহ্ন
বরগুনা প্রতিনিধি॥ বরগুনার প্রায় শতবর্ষী একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একজন প্রধান শিক্ষক নিয়োগের জটিলতায় ধসে পড়েছে স্বাভাবিক শিক্ষাব্যবস্থা। শিক্ষক নিয়োগের বিধি পাশ কাটিয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ, বর্ণিত প্রধান শিক্ষকের শিক্ষা সনদসহ নানা যোগ্যতার ঘাটতি থাকলেও তিনি প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ লাভ করেন। এর মধ্যে বিদ্যালয়টি জাতীয়করণের আওতায় গেলেও তছনছ হয়ে গেছে বিদ্যালয়ের শৃঙ্খলা, প্রশাসনিক ও শিক্ষা কার্যক্রম। ১৯৮৮ সাল থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে যথারীতি চাকরি করে চলেছেন তিনি।
১৯২৯ সালে প্রতিষ্ঠিত পাথরঘাটা কে এম মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক হিসেবে মো. নুরুল আলম পরিচালনা কমিটি কর্তৃক নিয়োগ পান ২০১৬ সালের ৪ মে। নিয়োগ পরীক্ষায় তিনি প্রথম স্থান অধিকার না করলেও নিয়োগ পান একটি কৌশলগত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে।
মো. নুরুল আলম পাথরঘাটা শহরের মৃত আমজাদ হোসেন হাওলাদারের পুত্র। পাথরঘাটা কে এম মডেল মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন। তিনি দ্বিতীয় স্থান অধিকার করলেও বিদ্যালয় ব্যবস্থাপনা কমিটি তাঁকেই প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করে। ২৯-০৪-২০১৬ তারিখে অনুষ্ঠিত হয় নিয়োগ পরীক্ষা। একই দিন কমিটির সভায় সিদ্ধান্ত হয়, প্রথম স্থান অধিকারকারী মো. জাহাঙ্গীর হোসেন যোগদান না করলে দ্বিতীয় স্থানপ্রাপ্ত ব্যক্তিকে প্রধান শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ প্রদান করা হবে। উপযুক্ত প্রার্থী না পেলে সরকারের নিয়োগবিধি মোতাবেক দ্বিতীয়বার বিজ্ঞাপন দিয়ে নিয়োগ পরীক্ষার আয়োজন করে শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার কথা বলা আছে বলে জানান বরগুনা জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. শাহদাত হোসেন।
মো. নুরুল আলম তাঁর শিক্ষাসনদেও করেছেন এন্তার জাল-জালিয়াতি। মাধ্যমিক, উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক দ্বিতীয় বিভাগে পাসের সনদ দাখিল করে নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হন অথচ তাঁর উচ্চ মাধ্যমিক ও স্নাতক পাসের সনদ জালিয়াতি করেছেন। বরগুনার বেতাগী সরকারি কলেজ ও পটুয়াখালী সরকারি কলেজ থেকে সনদ যাচাই করা হলে দেখা যায়, তিনি তৃতীয় শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়েছেন। যাচাই করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পাথরঘাটা কে এম মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় কমিটির সভাপতি মো. হুমায়ুন কবির।
বিদ্যালয়ের ব্যবস্থাপনা কমিটির তৎকালীন সভাপতি ও পাথরঘাটা পৌর মেয়র মো. আনেয়ার হোসেন আকন দাবি করেন, নিয়োগ পরীক্ষার সময় সব শিক্ষা সনদ যাচাই করে সঠিক পাওয়া গেছে বলেই তাঁকে তখন নিয়োগ দেওয়া হয়।
মো. নুরুল আলম প্রধান শিক্ষক নির্বাচিত হলেও বিগত প্রায় পাঁচ বছরে এমপিওভুক্ত হতে পারেননি তাঁর গোঁজামিল দেওয়া কাগজপত্রের কারণে। এ জন্য সে বিদ্যালয়ের তৎকালীন সভাপতির স্বাক্ষর জাল করে গোপনে চেষ্টা করেছেন। সাবেক সভাপতি ও পাথরঘাটা পৌর মেয়র মো. আনোয়ার হোসেন এবং পাথরঘাটা উপজেলা চেয়ারম্যান মো. রফিকুল ইসলাম রিপন মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে গত ০৫-০৮-২০২০ তারিখে লিখিত পত্র দিয়ে প্রধান শিক্ষকের জালজালিয়াতির কথা জানান। তাঁদের উভয়ের স্বাক্ষর জাল করে তিনি (নুরুল আলম) এমপিওভুক্ত হওয়ার চেষ্টা করেছেন বলে তারা দাবি করেন।
চাকরি বিষয়ে মাধ্যমিক শিক্ষা অধিদপ্তর কর্তৃক কারণ দর্শানোর জবাব দিতে গিয়ে মো. নুরুল আলম বরগুনা জেলা জজ কোর্টের এজিপির স্বাক্ষর জাল করে একটি মতামত উপস্থাপন করলে উপজেলা প্রশাসন কর্তৃক যাচাই করা হয়। বরগুনার জজ কোর্টের জিপি মো. মজিবর রহমান সেটাকে মো. নুরুল আলমের সৃজিত ও ভুয়া সনদ বলে লিখিত পত্রে উল্লেখ করেন।
মো. নুরুল আলমের জন্ম তারিখে রয়েছে অন্য এক রহস্য। জাতীয় পরিচয়পত্রে লেখা ১৯৬৪ সাল আবার শিক্ষা সনদে লেখা ১৯৬২ সাল। পাথরঘাটা কে এম মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সাবেক প্রধান শিক্ষক ও মুক্তিযোদ্ধা মো. মোস্তাফিজুর রহমান আক্ষেপ করে বলেন, একটি ঐতিহ্যবাহী বিদ্যালয়ের সুনাম ধ্বংস করা হচ্ছে প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেওয়ার ভুল প্রক্রিয়া গ্রহণ করায়। বিদ্যালয়টি রক্ষার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।
পাথরঘাটা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. হুমায়ুন কবির জানান, মো. নুরুল আলম ১৯৮৮ সাল থেকে আরো চারটি বিদ্যালয়ে সহকারী শিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন, তাঁর ইনডেক্স নাম্বার ২১০৬০০। প্রধান শিক্ষক হওয়ার জন্য একাধারে ১২ বছর চাকরির অভিজ্ঞতা না থাকলেও তিনি নিয়োগ পান।
পাথরঘাটা কে এম মডেল সরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. নুরুল আলম অভিযোগ অস্বীকার করে বলেন, তিনি কোনো জাল-জালিয়াতি করেননি। তিনি তাঁর নিয়োগ বৈধ বলে দাবি করেন।
Leave a Reply